ম্যারিনা নাসরীন
মনে করুন আপনার সামনে একটা সাদা রঙের বিশাল ক্যানভাস। আপনাকে বলা হলো ক্যানভাস আপনি এমন কিছু ঘটনার ছবি আঁকুন, যেগুলো গত এক মাসে আপনি দেখেছেন, শুনেছেন বা পত্রপত্রিকায় পড়েছেন। আমি নিশ্চিত, আপনার ছবিগুলোর মধ্যে আনন্দের খবর যদি ১০ পারসেন্ট থাকে, নিরানন্দের খবর থাকবে ৯০ পারসেন্ট। শুধু গত এক মাস নয়, তার আগের এক মাস, তারও আগের আরেক মাস। এমনভাবে বহুমাস আগের চিত্র একই হবে। এর কার দুই রকম হতে পারে। হয়, আপনি একজন নেতিবাচক চিন্তার মানুষ খারাপ, ঘটনাগুলো চোখে বেশি পড়ে অথবা আসলেই সমাজে নিরানন্দের ঘটনা অনেক বেশি ঘটছে!
সত্যি বলতে কি, অস্বাভাবিক একটা সময়ের মধ্যে আমরা চলেছি। আমরা ক্রমশ অসামাজিক এবং অনুভূতিবিবর্জিত নিষ্ঠুর প্রাণী হয়ে উঠছি। অ্যাপার্টমেন্ট-সর্বস্ব এই সমাজে মুখোমুখি দুটো ফ্ল্যাটের মানুষ কেউ কারো খবর রাখে না। ছুটির দিনে দুপুরে বা উৎসব পার্বণে পাশের বাড়িতে তরকারির বাটি পাঠানোর সেই রীতি নির্বাসিত হয়েছে অনেক আগেই। প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর আলাপচারিতা নেই, ভাইয়ের সঙ্গে বোনের হৃদ্যতা নেই, এমনকি মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের নাড়ির যোগটাও অনেক ক্ষীণ হয়ে এসেছে। যার কারণে বাবা-মায়ের হাতে সন্তান খুন হচ্ছে, সন্তানের হাতে বাবা-মা। এ তো গেল পরিবারের কথা। রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা আরো ভয়াবহ। একসময় ছিল ভালো বংশের সন্তানরা নেশায় পড়ে মানুষের জন্য কিছু করতে রাজনীতিতে আসতেন। এখন এটি পেশায় দাঁড়িয়েছে। তাঁরা দেশের মঙ্গলের জন্য যতটা না ভাবছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় দিচ্ছেন নিজের সুবিধা আদায় এবং অন্য দলের ছিদ্র খোঁজার কাজে।
ধীরে ধীরে স্বাধীন মতপ্রকাশের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মিথ্যা, অশ্রদ্ধা, পরমত অসহিষ্ণুতা, চটুলতা, কুটিলতা এবং হিংসা-বিদ্বেষের বিষে সমাজ ক্রমেই নীল বর্ণ ধারণ করছে। দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যার ফলে দেশের অর্থনৈতিক চাকা সামনের দিকে ঘুরছে মনে হলেও তার সুবিধা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপ্তি লাভ করছে না।
আমাদের সমাজে মেয়েরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারছে না। ধর্ষণ, খুন, গুম নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। আমরা এসব দৃশ্যে কোথাও স্থির হচ্ছি না। আমাদের দৃষ্টি টিভি থেকে পত্রিকায়, পত্রিকা থেকে সামাজিক নেটওয়ার্কে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অস্থির একটা সময় অতিক্রম করছি আমরা। এবং আমরা একটা সুখের খবর যতটা না প্রচার করছি তার তুলনায় অনেক বেশি প্রচার করছি অসুখের ঘটনার। এই যে একটা অস্থির বলয়, সেটা থেকে আমরা কীভাবে বেরিয়ে আসতে পারি? অভিজ্ঞতা যা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আশা করে লাভ কিছু নেই। বরং আমাদের নিজেদেরই উদ্যোগী হতে হবে। নিজেদের ভঙ্গুর আদর্শকে শুধু মেরামত করলে চলবে না, ছেনি-কাঁচি নিয়ে রীতিমতো সংস্কার করতে হবে। তবেই দম বন্ধ হয়ে আসা এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। ভেবে দেখুন, সমাজ বা রাষ্ট্রে যারা অন্যায়, অবিচার, পাপে লিপ্ত, তাঁরা প্রত্যেকে কোনো না কোনো মা-বাবার সন্তান। কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য এবং তাঁরা আমাদের সমাজেই বাস করেন। সুতরাং সংস্কার শুরু করতে হবে পরিবার থেকে, তারপর সমাজ, রাষ্ট্র। প্রতিবেশীর সন্তানের দোষত্রুটি ধরার আগে নিজের সন্তানটি নির্দোষ কি না সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।
আমাদের বাবা-মায়েরা একসময় বুঝতে শেখার সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের হাতে আদর্শলিপি তুলে দিতেন। ‘সদা সত্য কথা বলিবে, কদাপি মিথ্যা বলিবে না’। ‘জীবে দয়া কর’। ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। তখন মানুষ শিশু বয়স থেকেই এসব নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বড় হতো। বর্তমানে শিশুরা অক্ষরজ্ঞানের আগেই মোবাইল ফোনের নাড়ি নক্ষত্র জেনে ফেলে। সেন্ড বাটন, লগইন বাটন চিনে নেয়। টিভির সিরিয়াল থেকে কার্টুন থেকে অথবা পারিপার্শ্বিকতা থেকে জেনে যায় মায়ের সঙ্গে কীভাবে মিথ্যা কথা বলতে হবে। সেটি হয় অপরাধের হাতে খড়ি। কিন্তু মানবজীবনের কোনটি মানবিক আর কোনটি অমানবিক সেটি সম্পর্কে তারা ধারণা পায় না। পরিবার থেকে যারা নৈতিক শিক্ষা পায় না, তারাই পরবর্তীকালে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
কথায় কথায় আমরা সিভিলাইজেশনের কথা বলি। যথেষ্ট সভ্য হয়েছি বলে বড়াই করি। সভ্যতার চাকা ঘুরতে ঘুরতে আমরা একবিংশ শতাব্দীর ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাচ্ছি কিন্তু আদৌ কি সভ্য হয়েছি? প্রতিনিয়ত কম্পিউটার আপডেটের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো আমরা প্রযুক্তিগতভাবে আপডেট হচ্ছি কিন্তু নৈতিকতার দিকে আমাদের চারিত্রিক আপডেট কি আদৌ হয়েছে? কথা যা ভালো, তার সবকিছু মুহূর্তে মুহূর্তে অতীত হয়ে যাচ্ছে। সেই গানটির মতো ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।
আসুন ভালো সবকিছুই আমাদের তিনটি কালকেই ঘিরে রাখুক। আমরা আবার আদর্শলিপি হাতে তুলে নিই এবং প্রতিজ্ঞা করি, সদা সত্য কথা বলিব, কদাপি মিথ্যা বলিব না। তর্কালংকারের কবিতা পড়ি এবং সে অনুযায়ী কাজ করি।
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।
ভালো থাকুন সবাই, ভালোবাসায় থাকুন। সত্য এবং সুন্দরের সঙ্গে।
লেখক : গল্পকার
No comments:
Post a Comment