Latest News

শবে বরাত সম্পর্কে ইসলামের বর্ণনা

শবে বরাত সম্পর্কে ইসলামের বর্ণনা


মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কতিপয় মূলনীতি উল্লেখ করছি যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস।

(এক) যদি কোন একটা প্রথা যুগ যুগ ধরে কোন অঞ্চলের মুসলিম সমাজে চলে আসে, তাহলে তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার প্রমাণ বহন করেনা। এটা বলা ঠিক হবে না যে, শত শত বছর ধরে যা পালন করে আসছি তা না জায়েয হয় কিভাবে? বরং তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই শর’য়ী দলীল থাকতে হবে।

(দুই) ইসলামের যাবতীয় বিষয়াবলী দু’ প্রকার (ক) আকীদাহ বা বিশ্বাস (খ) ‘আমল বা কাজ। কোন ‘আমল বা কাজ ইসলামের শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস এই চারটির যে কোন একটি দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। কিন্তু আকীদাগত কোন বিষয় অবশ্যই কুরআন অথবা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। ইজমা অথবা কিয়াস দ্বারা আকীদাহর কোন বিষয় প্রমাণ করা যাবে না।

(তিন) যে সকল হাদীস কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লিখিত সবগুলো হাদীস বিশুদ্ধ বা সহীহ নয়। হাদীস বিশারদগণ যুগ যুগ ধরে গবেষণা করে নির্ধারণ করেছেন কোনটি সহীহ, কোনটি যয়ীফ (দুর্বল সূত্র), কোনটি মওজু (জাল বা বানোয়াট)। তাই সব ধরনের হাদীস মোতাবেক ‘আমল করা ঠিক নয়। হাদীসসমূহ থেকে শুধু সহীহগুলি ‘আমলে নেয়া হবে। যদি সব ধরনের হাদীস ‘আমলে নেয়া হয় তাহলে শত শত বছর ধরে এ বিষয় গবেষণা ও তা চর্চার সার্থকতা কি?

(চার) দুর্বল বা জাল হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইসলামী শরীয়তে কোন আকীদাহ ও ‘আমল চালু করা যায় না। তবে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কোন ‘আমলের ফাযীলাতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়।

(পাঁচ) কোন স্থান বা সময়ের ফযীলাত কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলে তা দ্বারা সে স্থানে বা সে সময়ে ‘আমল (ইবাদাত-বন্দেগী) করার ফযীলাত প্রমাণিত হয়না। যদি ‘আমল করার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র শরয়ী দলীল থাকে তাহলেই ‘আমল করা যায়।

‘শবে বরাত’ এর অর্থ

‘শব’ একটি ফারসী শব্দ এর অর্থ রাত। ‘বারায়াত’কে যদি আরবী শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। যেমন কুরআন মাজীদে সূরা বারায়াত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত। ইরশাদ হয়েছে :

بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ (التوبة: ১)

অর্থ : আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা। (সূরা তাওবা, ১)

এখানে বারায়াতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‘বারায়াত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে যেমন :

أَكُفَّارُكُمْ خَيْرٌ مِنْ أُولَئِكُمْ أَمْ لَكُمْ بَرَاءَةٌ فِي الزُّبُرِ . (سورة القمر :৪৩)

অর্থ : তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? না কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাবসমূহে? (সূরা কামার, ৩৪)

আর ‘বারায়াত’ শব্দক যদি ফারসী শব্দ ধরা হয় তাহলে উহার অর্থ হবে সৌভাগ্য। অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাড়ায় মুক্তির রজনী, সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। অথবা সৌভাগ্যের রাত, যদি ‘বরাত’ শব্দটিকে ফার্সী শব্দ ধরা হয়।

শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবীতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত’। এখানে বলে রাখা ভাল যে এমন অনেক শব্দ আছে যার রূপ বা উচ্চারণ আরবী ও ফারসী ভাষায় একই রকম, কিন্তু অর্থ ভিন্ন।

যেমন ‘গোলাম’ শব্দটি আরবী ও ফারসী উভয় ভাষায় একই রকম লেখা হয় এবং একইভাবে উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু আরবীতে এর অর্থ হল কিশোর আর ফারসীতে এর অর্থ হল দাস।

সার কথা হল ‘বারায়াত’ শব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য।

আল-কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই

শবে বরাত বলুন আর লাইলাতুল বারায়াত বলুন কোন আকৃতিতে শব্দটি কুরআন মাজীদে খুজে পাবেন না। সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুরআন মাজীদে শবে বরাতের কোন আলোচনা নেই। সরাসরি তো দূরের কথা আকার ইংগিতেও নেই।

অনেককে দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে যেয়ে সূরা দুখানের প্রথম চারটি আয়াত পাঠ করেন। আয়াতসমূহ হল :

حم ﴿১﴾ وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ ﴿২﴾ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ ﴿৩﴾ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ ﴿৪﴾ (الدخان: ১-৪)

অর্থ : হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা দুখান, ১-৪)

শবে বরাত পন্থী আলেম উলামারা এখানে বরকতময় রাত বলতে ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন। আমি এখানে স্পষ্টভাবেই বলব যে, যারা এখানে বরকতময় রাতের অর্থ ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন তারা এমন বড় ভুল করেন যা আল্লাহর কালাম বিকৃত করার মত অপরাধ। কারণ :

(এক) কুরআন মাজীদের এ আয়াতের তাফসীর বা ব্যাখ্যা সূরা আল-কদর দ্বারা করা হয়। সেই সূরায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ﴿১﴾ وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ ﴿২﴾ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ ﴿৩﴾ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ ﴿৪﴾ سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ ﴿৫﴾

অর্থ : আমি এই কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য মালাইকা (ফেরেশ্‌তাগণ) ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। এই শান্তি ও নিরাপত্তা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা কাদর, ১-৫)

অতএব বরকতময় রাত হল লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল বারায়াত নয়। সূরা দুখানের প্রথম সাত আয়াতের ব্যাখ্যা হল এই সূরা আল-কদর। আর এ ধরনের ব্যাখ্যা অর্থাৎ আল-কুরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করা হল সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।

(দুই) সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকার অর্থ যদি শবে বরাত হয় তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাড়ায় আল কুরআন শাবান মাসের শবে বরাতে নাযিল হয়েছে। অথচ আমরা সকলে জানি আল-কুরআন নাযিল হয়েছে রামাযান মাসের লাইলাতুল কদরে।

যেমন সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন :

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ.

অর্থ : রামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন।

(তিন) অধিকাংশ মুফাচ্ছিরে কিরামের মত হল উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। শুধু মাত্র তাবেয়ী ইকরামা রহ. এর একটা মত উল্লেখ করে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতকেও বুঝানো যেতে পারে।

তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। যা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য। এ বরকতময় রাতের দ্বারা উদ্দেশ্য যদি শবে বরাত হয় তাহলে শবে কদর অর্থ নেয়া চলবেনা।

(চার) উক্ত আয়াতে বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা শবে বরাত করা হল তাফসীর বির-রায় (মনগড়া ব্যাখ্যা), আর বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা লাইলাতুল কদর দ্বারা করা হল কুরআন ও হাদীস সম্মত তাফসীর। সকলেই জানেন কুরআন ও হাদীস সম্মত ব্যাখ্যার উপস্থিতিতে মনগড়া ব্যাখ্যা (তাফসীর বির-রায়) গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই।

(পাচ) সূরা দুখানের ৪ নং আয়াত ও সূরা কদরের ৪ নং আয়াত মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে কাসীর, কুরতুবী প্রমুখ মুফাচ্ছিরে কিরাম এ কথাই জোর দিয়ে বলেছেন এবং সূরা দুখানের ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র অর্থ শবে বরাত নেয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। (তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন দ্রষ্টব্য)

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাফসীরে বলেছেন : “কোন কোন আলেমের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত)। কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।”

অতএব এ আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ এর অর্থ লাইলাতুল কদর। শাবান মাসের পনের তারিখের রাত নয়।

(ছয়) ইকরামা (রঃ) বরকতময় রজনীর যে ব্যাখ্যা শাবানের ১৫ তারিখ দ্বারা করেছেন তা ভুল হওয়া সত্ত্বেও প্রচার করতে হবে এমন কোন নিয়ম-কানুন নেই। বরং তা প্রত্যাখ্যান করাই হল হকের দাবী। তিনি যেমন ভুলের উর্ধ্বে নন, তেমনি যারা তার থেকে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনে থাকতে পারেন অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বানোয়াট বর্ণনা দেয়াও অসম্ভব নয়।

(সাত) শবে বরাতের গুরুত্ব বর্ণনায় সূরা দুখানের উক্ত আয়াত উল্লেখ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এ আকীদাহ বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, শবে বরাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মাউত, রিয্‌ক-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয়। আর শবে বরাত উদযাপনকারীদের শতকরা নিরানব্বই জনের বেশী এ ধারণাই পোষণ করেন। তারা এর উপর ভিত্তি করে লাইলাতুল কদরের চেয়ে ১৫ শাবানের রাতকে বেশী গুরুত্ব দেয়। অথচ কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ বিষয়গুলি লাইলাতুল

No comments:

Post a Comment

0
শবে বরাত সম্পর্কে ইসলামের বর্ণনা


মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কতিপয় মূলনীতি উল্লেখ করছি যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস।

(এক) যদি কোন একটা প্রথা যুগ যুগ ধরে কোন অঞ্চলের মুসলিম সমাজে চলে আসে, তাহলে তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার প্রমাণ বহন করেনা। এটা বলা ঠিক হবে না যে, শত শত বছর ধরে যা পালন করে আসছি তা না জায়েয হয় কিভাবে? বরং তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই শর’য়ী দলীল থাকতে হবে।

(দুই) ইসলামের যাবতীয় বিষয়াবলী দু’ প্রকার (ক) আকীদাহ বা বিশ্বাস (খ) ‘আমল বা কাজ। কোন ‘আমল বা কাজ ইসলামের শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস এই চারটির যে কোন একটি দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। কিন্তু আকীদাগত কোন বিষয় অবশ্যই কুরআন অথবা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। ইজমা অথবা কিয়াস দ্বারা আকীদাহর কোন বিষয় প্রমাণ করা যাবে না।

(তিন) যে সকল হাদীস কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লিখিত সবগুলো হাদীস বিশুদ্ধ বা সহীহ নয়। হাদীস বিশারদগণ যুগ যুগ ধরে গবেষণা করে নির্ধারণ করেছেন কোনটি সহীহ, কোনটি যয়ীফ (দুর্বল সূত্র), কোনটি মওজু (জাল বা বানোয়াট)। তাই সব ধরনের হাদীস মোতাবেক ‘আমল করা ঠিক নয়। হাদীসসমূহ থেকে শুধু সহীহগুলি ‘আমলে নেয়া হবে। যদি সব ধরনের হাদীস ‘আমলে নেয়া হয় তাহলে শত শত বছর ধরে এ বিষয় গবেষণা ও তা চর্চার সার্থকতা কি?

(চার) দুর্বল বা জাল হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইসলামী শরীয়তে কোন আকীদাহ ও ‘আমল চালু করা যায় না। তবে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কোন ‘আমলের ফাযীলাতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়।

(পাঁচ) কোন স্থান বা সময়ের ফযীলাত কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলে তা দ্বারা সে স্থানে বা সে সময়ে ‘আমল (ইবাদাত-বন্দেগী) করার ফযীলাত প্রমাণিত হয়না। যদি ‘আমল করার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র শরয়ী দলীল থাকে তাহলেই ‘আমল করা যায়।

‘শবে বরাত’ এর অর্থ

‘শব’ একটি ফারসী শব্দ এর অর্থ রাত। ‘বারায়াত’কে যদি আরবী শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। যেমন কুরআন মাজীদে সূরা বারায়াত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত। ইরশাদ হয়েছে :

بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ (التوبة: ১)

অর্থ : আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা। (সূরা তাওবা, ১)

এখানে বারায়াতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‘বারায়াত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে যেমন :

أَكُفَّارُكُمْ خَيْرٌ مِنْ أُولَئِكُمْ أَمْ لَكُمْ بَرَاءَةٌ فِي الزُّبُرِ . (سورة القمر :৪৩)

অর্থ : তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? না কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাবসমূহে? (সূরা কামার, ৩৪)

আর ‘বারায়াত’ শব্দক যদি ফারসী শব্দ ধরা হয় তাহলে উহার অর্থ হবে সৌভাগ্য। অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাড়ায় মুক্তির রজনী, সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। অথবা সৌভাগ্যের রাত, যদি ‘বরাত’ শব্দটিকে ফার্সী শব্দ ধরা হয়।

শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবীতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত’। এখানে বলে রাখা ভাল যে এমন অনেক শব্দ আছে যার রূপ বা উচ্চারণ আরবী ও ফারসী ভাষায় একই রকম, কিন্তু অর্থ ভিন্ন।

যেমন ‘গোলাম’ শব্দটি আরবী ও ফারসী উভয় ভাষায় একই রকম লেখা হয় এবং একইভাবে উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু আরবীতে এর অর্থ হল কিশোর আর ফারসীতে এর অর্থ হল দাস।

সার কথা হল ‘বারায়াত’ শব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য।

আল-কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই

শবে বরাত বলুন আর লাইলাতুল বারায়াত বলুন কোন আকৃতিতে শব্দটি কুরআন মাজীদে খুজে পাবেন না। সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুরআন মাজীদে শবে বরাতের কোন আলোচনা নেই। সরাসরি তো দূরের কথা আকার ইংগিতেও নেই।

অনেককে দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে যেয়ে সূরা দুখানের প্রথম চারটি আয়াত পাঠ করেন। আয়াতসমূহ হল :

حم ﴿১﴾ وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ ﴿২﴾ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ ﴿৩﴾ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ ﴿৪﴾ (الدخان: ১-৪)

অর্থ : হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা দুখান, ১-৪)

শবে বরাত পন্থী আলেম উলামারা এখানে বরকতময় রাত বলতে ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন। আমি এখানে স্পষ্টভাবেই বলব যে, যারা এখানে বরকতময় রাতের অর্থ ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন তারা এমন বড় ভুল করেন যা আল্লাহর কালাম বিকৃত করার মত অপরাধ। কারণ :

(এক) কুরআন মাজীদের এ আয়াতের তাফসীর বা ব্যাখ্যা সূরা আল-কদর দ্বারা করা হয়। সেই সূরায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ﴿১﴾ وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ ﴿২﴾ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ ﴿৩﴾ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ ﴿৪﴾ سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ ﴿৫﴾

অর্থ : আমি এই কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য মালাইকা (ফেরেশ্‌তাগণ) ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। এই শান্তি ও নিরাপত্তা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা কাদর, ১-৫)

অতএব বরকতময় রাত হল লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল বারায়াত নয়। সূরা দুখানের প্রথম সাত আয়াতের ব্যাখ্যা হল এই সূরা আল-কদর। আর এ ধরনের ব্যাখ্যা অর্থাৎ আল-কুরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করা হল সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।

(দুই) সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকার অর্থ যদি শবে বরাত হয় তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাড়ায় আল কুরআন শাবান মাসের শবে বরাতে নাযিল হয়েছে। অথচ আমরা সকলে জানি আল-কুরআন নাযিল হয়েছে রামাযান মাসের লাইলাতুল কদরে।

যেমন সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন :

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ.

অর্থ : রামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন।

(তিন) অধিকাংশ মুফাচ্ছিরে কিরামের মত হল উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। শুধু মাত্র তাবেয়ী ইকরামা রহ. এর একটা মত উল্লেখ করে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতকেও বুঝানো যেতে পারে।

তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। যা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য। এ বরকতময় রাতের দ্বারা উদ্দেশ্য যদি শবে বরাত হয় তাহলে শবে কদর অর্থ নেয়া চলবেনা।

(চার) উক্ত আয়াতে বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা শবে বরাত করা হল তাফসীর বির-রায় (মনগড়া ব্যাখ্যা), আর বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা লাইলাতুল কদর দ্বারা করা হল কুরআন ও হাদীস সম্মত তাফসীর। সকলেই জানেন কুরআন ও হাদীস সম্মত ব্যাখ্যার উপস্থিতিতে মনগড়া ব্যাখ্যা (তাফসীর বির-রায়) গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই।

(পাচ) সূরা দুখানের ৪ নং আয়াত ও সূরা কদরের ৪ নং আয়াত মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে কাসীর, কুরতুবী প্রমুখ মুফাচ্ছিরে কিরাম এ কথাই জোর দিয়ে বলেছেন এবং সূরা দুখানের ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র অর্থ শবে বরাত নেয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। (তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন দ্রষ্টব্য)

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাফসীরে বলেছেন : “কোন কোন আলেমের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত)। কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।”

অতএব এ আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ এর অর্থ লাইলাতুল কদর। শাবান মাসের পনের তারিখের রাত নয়।

(ছয়) ইকরামা (রঃ) বরকতময় রজনীর যে ব্যাখ্যা শাবানের ১৫ তারিখ দ্বারা করেছেন তা ভুল হওয়া সত্ত্বেও প্রচার করতে হবে এমন কোন নিয়ম-কানুন নেই। বরং তা প্রত্যাখ্যান করাই হল হকের দাবী। তিনি যেমন ভুলের উর্ধ্বে নন, তেমনি যারা তার থেকে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনে থাকতে পারেন অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বানোয়াট বর্ণনা দেয়াও অসম্ভব নয়।

(সাত) শবে বরাতের গুরুত্ব বর্ণনায় সূরা দুখানের উক্ত আয়াত উল্লেখ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এ আকীদাহ বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, শবে বরাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মাউত, রিয্‌ক-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয়। আর শবে বরাত উদযাপনকারীদের শতকরা নিরানব্বই জনের বেশী এ ধারণাই পোষণ করেন। তারা এর উপর ভিত্তি করে লাইলাতুল কদরের চেয়ে ১৫ শাবানের রাতকে বেশী গুরুত্ব দেয়। অথচ কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ বিষয়গুলি লাইলাতুল

Post a Comment

Dear readers, after reading the Content please ask for advice and to provide constructive feedback Please Write Relevant Comment with Polite Language.Your comments inspired me to continue blogging. Your opinion much more valuable to me. Thank you.